গারো পাহাড়ের দেশ নেত্রকোণা

ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জেলা নেত্রকোণা। কংস, সোমেশ্বরী, গণেশ্বরী, মহেশ্বরী, ঘোড়াউত্রা নদীবিধৌত নেত্রকোণা জেলা খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটগণের অধীন ছিল। সমুদ্রগুপ্তের অধীনস্থ এ অঞ্চলসহ পশ্চিম ময়মনসিংহ কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুরাজ শশাংকের আমন্ত্রণে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ যখন কামরূপ অঞ্চলে আসেন, তখন পর্যন্ত নারায়ণ বংশীয় ব্রাহ্মণ কুমার ভাস্কর বর্মণ কর্তৃক কামরূপ রাজ্য পরিচালিত ছিল। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তরাংশে পাহার মুল্লুকে বৈশ্যগারো ও দুর্গাগারো তাদের রাজত্ব পরিচালনা করতো। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মুসলিম রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত হয়। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ-র উত্তরাধিকারীরা ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপর আধিপত্য বজায় রাখতে পারেনি। ময়মনসিংহের উত্তরাংশ কোচদের পুনরাধীন হয়ে পড়ে।

রাজধানী দিল্লী থেকে অনেক দূরে ও কেন্দ্রীয় রাজশক্তির দূর্বলতার সুযোগে প্রধান রাজস্ব সচিব দেওয়ান সুলায়মান খাঁ (যিনি পূর্বে কালিদাস গজদানী নামে পরিচিত ছিলেন) সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করেন। কেন্দ্রীয় শাসকের প্রেরিত সৈন্যদের হাতে সোলায়মান খাঁ নিহত হলেও তার দু’পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশা খাঁ খিজিরপুর থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ঈশা খাঁ’র মৃত্যুর পর তার পুত্র মুসা খাঁ ও আফগান সেনা খাজা উসমান খাঁ কর্তৃক অত্রাঞ্চল শাসিত ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মোঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

মোগল সেনাদের যুদ্ধ কৌশল জনিত কারণে অনেক দুর্গ প্রতিষ্ঠা হয়। এছাড়া পূর্ববর্তী শাসকদের তৈরী ভগ্নদুর্গও তারা সংস্কার সাধন করে ব্যবহার করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোয়াই বাড়ি দূর্গ যা পরবর্তীকালে ঈশা খাঁ’র পারিষদ মসজিদ জালাল এর আবাস বাটী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

নেত্রকোণা জেলায় অনেক প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে। সে সকল স্থাপত্যগুলো অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। কিছু স্থাপত্য এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। নেত্রকোণার ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মদনপুরের হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি(র) মাজার, শাহ্ সুখূল আম্বিয়া মাজারের পাশে মোগল যুগের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, পুকুরিয়ার ধ্বংশপ্রাপ্ত দূর্গ, নাটেরকোণার ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমারতের স্মৃতি চিহৃ, দূর্গাপুর মাসকান্দা গ্রামের সুলতানি যুগের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ।

নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর, বন-জঙ্গলের জনপদ ছিল সমগ্র নেত্রকোণা। লোক সাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষকদের মতে পূর্ব ময়মনসিংহ হলো লোক ও সাহিত্য সংস্কৃতির এক তীর্থ ভূমি। নেত্রকোণার সন্তান চন্দ্র কুমার দে সংগৃহীত এবং ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত বিশ্ব নন্দিত গ্রন্থ মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের পর থেকে পূর্ব ময়মনসিংহকে অনেক গবেষক মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চল বলেও চিহ্নিত করে থাকেন। এই মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিত করা হয়-উত্তরে গারো পাহাড়, দক্ষিণে মেঘনা, যমুনা সঙ্গমস্থল, পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং পূর্বে সুরমা কুশিয়ারা নদী। এই মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চলের লোক সাহিত্য সংস্কৃতি, ভোগলিক ও ঐতিহাসিক বিচার-বিশ্নেষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো নেত্রকোণা।

নইদ্যা ঠাকুর বা নদের চাঁদের পালাগান (ময়মনসিংহ গীতিকা)
বিখ্যাত মৈয়মনসিংহ গীতিকার মূল চরিত্র নদের চাঁদ ও মহুয়া। নদের চাঁদের বসতভিটা সুসং দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ঝাঞ্ছাজাইল বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে বাউরতলা গ্রামের পাশে।

প্রায় সাড়ে তিশ বছর পূর্বে কবি দ্বিজ কানাই (কেন্দুয়া উপজেলা) মহুয়ার পালা নামে একটি পালা গান শুরু করেন। কবি চন্দ্র কুমার দে ১৯২১ সালে ৯ মার্চ মহুয়ার পালা গানটি সংগ্রহ করেন। ১৯২৩ সালের ২৪ নভেম্বর ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন মহুয়ার পালা গানটি সম্পাদনা করেন। এই পালায় ৭৫৫টি পঙতি ও ২৪ অধ্যায় রয়েছে।

কথিত আছে যে, নদের চাঁদের বসতভিটা সুসং দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ঝাঞ্ছাজাইল বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে বাউরতলা গ্রামের পাশে। সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদ ছিলেন এক জমিদারের দেওয়ান। অপর পক্ষে রূপবতি মহুয়া বেদে সরদার হুমরা বেদের পালিত কন্যা, যাকে শিশুকালে হুমরা বেদে নেত্রকোণার কাঞ্চণপুর থেকে ডাকাতি করে নিয়ে আসে। জানা যায়, বেদে মহুয়াও এক সভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। বেদেরা ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলত ও হাট বাজারে পাড়ায় সাপের খেলা দেখাত। বেদে মহুয়া যখন নদের চাঁদের গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে আসেন তখন মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে নদের চাঁদ তাকে প্রণয় নিবেদন করেন। মহুয়াও নদের চাঁদের প্রণয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু দুজনের প্রণয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরদার হুমরা বেদে। এক দিন নদের চাঁদ মহুয়াকে নিয়ে পালিয়ে যান। এদিকে হুমরা বেদে তা জানতে পেরে দলবল নিয়ে তাঁদের পিছু ধাওয়া করে। অবশেষে তারা মহুয়া এবং নদের চাঁদকে ধরে ফেলে। হুমরা বেদে নদের চাঁদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সরদার মহুয়ার হাতে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে বলে ‘‘যাও নদের চাঁদকে মেরে ফেল’’। বিষলক্ষা ছুরি নিয়ে মহুয়া নদের চাঁদের দিকে এগিয়ে যান। নদের চাঁদের সম্মুখে পৌছে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে তিনি তাঁর নিজের বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং মাটিতে ঢলে পড়েন। প্রণয় পিয়াসী নদের চাঁদ মহুয়ার এই আত্মত্যাগ সহ্য করতে না পেরে প্রেমের প্রতিদান সরূপ বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে নিজ জীবন আত্মহুতি দেন। মহুয়া ও নদের চাঁদের এই আত্ম ত্যাগ চিরন্তন প্রেমকে মহিমান্বিত করেছে। আজও সেই প্রেমের অমর কহিনী লোক মুখে মুখে বিরাজমান।

বিয়ের গান
নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে বিয়ের ধুম লাগে। বিশেষ করে নেত্রকোনা জেলার ভাটি অঞ্চল খালিয়াজুরী ও কলামাকান্দা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এসময় বিয়ের অনুষ্ঠান বেশি হতে দেখা যায়। কৃষকরা ভালো ফসল পেলে সারা বছর তারা থাকে আনন্দে। আর যদি একবার বন্যায় ধান তলিয়ে যায় তাহলে তারা হয়ে যায় নিঃস্ব। ধান ভালো হলে প্রতি ঘরে ঘরে বয়ে যায় দারুন খুশীর বন্যা। পিঠা-পায়েশ খাওয়ার ধুম লেগে যায়। যে গৃহস্থ মেয়ে বা ছেলের বিয়ে দিতে বা করাতে পারেনা, তারা তখন ছেলে বা মেয়েদের বিয়ে দেবার জন্য তৎপর হন। বাড়ি বাড়ি চলে বিয়ের গীত। বর্ষা মৌসুমে নৌপথে যাতায়াতের সুবিধা থাকার কারণে তখন এইসব এলাকায় বিয়ের অনুষ্ঠান বেশি হয়। কারণ নৌকায় বা ট্রলারে করে বর-কনে আসা যাওয়া করতে তাদের অনেক সুবিধা। নদীর উপর দিয়ে ট্রলারে করে বিয়ের বর আর বরযাত্রীরা বাদ্য বাজনা নিয়ে বিয়ে করতে যায়। আগের দিনে ট্রলারের উপর মাইক বাজিয়ে বর আর বরযাত্রীরা যেত। কিন্তু বর্তমানে ড্রামসেট বাজিয়ে ট্রলারের ছাদে চলে লাঠি খেলা, ছোট-বড়দের নাচ আর গান। নদী আর হাওরের দু’পাশে দাঁড়িয়ে সেদৃশ্য দেখে গায়ের বধুরা। মনে পরে যায় তাদের বিয়ের সময়ের কথা। তারা একে-অন্যের সাথে বিয়ের কথা বলে আর হাসি ঠাট্টা করতে থাকে। মূলত কি যেন এক অনাবিল আনন্দ তারা উপভোগ করে।

এদিকে কনের বাড়িতে সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বিয়ের গীত। যে সমস্ত গীত শোনা যায় সেগুলো হলো ‘জামাইগো জামাই, রঙ্গিলা জামাই, বুঝাওগো আমারে, পুকুরেতে নাইকো জল, পাড় কেন ডুবে’ অথবা ‘বাঁশি থাকে কদম তলে, চল সখি যমুনার জলে, সখিগো ঘরে আছে কাল ননদী, শ্বাশুড়ী হয় ঘরের বাদি’। উপরের কথাগুলো কোন গান নয়, এগুলো হচ্ছে নেত্রকোণার হাওর এলাকার বিয়ের গীত। বাড়ির বয়স্ক মহিলা এবং প্রতিবেশীরা মিলে এই সমস্ত গীত একসাথে বসে পরিবেশন করেন। আর মাইকে বাজতো ‘হলুদ বাট মেন্দি বাট…বিয়ের সাজে সাজবে কন্যা’ এরকম গান।

খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাওর এলাকার বিয়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন, যাতায়াতের সুবিধার জন্যই বর্ষাকালে হাওর এলাকার গ্রামগুলোতে বিয়ের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বলা চলে এই তখন বিয়ের মৌসুম। এছাড়া যে বছর ধান ভাল হয়, সে বছরই এইসব এলাকায় বিয়ের ধুম পড়ে যায়। ধান না হলে বিয়ে বন্ধ। এটাই হলো এই এলাকার রীতি। একবার এই হাওড়ের বোরো ফসল বন্যায় ধ্বংশ হলে তার জের ৩/৪ বছর পর্যন্ত চলে। ফলে বিয়েও বন্ধ থাকে ৩/৪ বছর। বন্যায় কন্যার পিতাদের থাকতে হয় নানান অসুবিধায়।

এই এলাকার মানুষের বসবাস ধরতে গেলে পানিতে। বছরের ৭/৮ মাস পানিতেই বসবাস করতে হয় তাদের। বিয়েও তাই পানির সময় হয়ে থাকে। আনন্দে আর খুশিতে মন ভরে যায় হাওড়বাসীর। তখন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতা মুক্তির স্বাদে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন।

রানী খং মিশন
দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে কাল্লাগড়া ইউনিয়নের উত্তর পূর্ব সীমান্তে সোমেশ্বরী নদীর কোল ঘেঁষেই পুরো মিশনটি একটি উচু পাহাড়ে অবস্থিত। ১৯১০ সালে এ রাণীখং মিশনটি স্থাপিত হয়। ইহা খ্রীষ্টিয় ক্যাথলিক ধর্মপল্লী। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের একটি উপাসনালয়। সুরম্য একটি গীর্জাসহ একটি দাতব্য চিকিৎসালয়, দুইটি স্কুল ও একটি পোষ্ট অফিস আছে। ইহা ছাড়া মিশনের ভিতরে শান্তিনিকেতন নামে একটি বিশ্রামাগার আছে, যেখান থেকে প্রকৃতিকে আরো নিবিড়ভাবে উপভোগ করা যায়।

রাণীখং নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তী আছে যে, এ অঞ্চলে ‘‘খং-রাণী’’ নামে এক রাক্ষস বাস করত। গারো আদিবাসীরা এই রাক্ষসটিকে হত্যা করে এ অঞ্চলে শান্তি এনেছিল। যার ফলে এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল রাণীখং। রানীখং নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত বলে এ মিশনটির নাম রানীখং মিশন।

প্রকৃতির অপরুপ লীলাভূমি রাণীখং মিশন। পাহাড় চুড়ায় গড়ে উঠা মিশনটির পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা পাহাড়ী নদী ‘সোমেশ্বরী’। মিশনটির সম্মুখে বিস্তির্ণ সাদা সিলিকা বালি। ছোট বড় সারি সারি টিলা-পাহাড় মিশে গেছে দিগন্ত জুড়ে। পা বাড়ালেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। এখান থেকেই উপভোগ করা যায় পাহাড় আর মেঘের লুকোচুরি খেলা আর নীলিমায় ভেসে যাওয়া বনবিহার।

নৌকাযোগে সরাসরি রাণীখং মিশনে পৌঁছানো যায়। এছাড়া রিক্সা বা মোটর সাইকেলে অর্ধ-কাচা ও অর্ধ-পাকা রাস্তা দিয়ে রাণীখং পৌছা যায়।

উচু পাহাড়ে মিশন অবস্থিত, তা হেটে উঠতে হয়।

রোয়াইল বাড়ির প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন
নেত্রকোণা জেলার অন্তর্গত কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে কেন্দুয়া ঢাকা সড়ক হয়ে প্রায় ১৩ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে বেতাই নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত পুরার্কীতি কেন্দুয়ার রোয়াইল বাড়ী।

১৯৯২ খৃস্টাব্দে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কতৃক রোয়াইল বাড়িতে খনন কাজ পরিচালিত হলে বেরিয়ে আসে মসজিদ, দূর্গ, রাস্তা, পরিখা, কবরস্থান ও অনেক অট্টালিকা। তারমধ্যে বারোদুয়ারী ঢিবির দক্ষিণাংশে সমতল ভূমি। খননে আরো পাওয়া গেছে কারুকার্যময় অট্টালিকার চিহ্ন ও দূর্গে সৈনিকদের কুচকাওয়াজের প্রসস্ত মাঠ। ঐ প্রাচীন চিহ্নবহ স্থানটি ৮ হেক্টর। এটি আয়তকার ছিল বলে ধারনা করা হয়। দক্ষিণে বেতাই নদীর তীর ঘেঁষে ভাঙ্গন অথবা নোঙ্গরঘাটের জন্য দেয়াল গাঁথুনি ছিল। মূল দুর্গের দৈঘ্য ৪৫০ মিটার ও প্রস্থ ১৫৭ মিটার। ইটের পরিমাণ ৩৭১৮৬ সেন্টিমিটার। সন্মুখভাগে জোড়াদিঘি। এর একটির দৈঘ্য ২৭০ মিটার ও প্রস্থ ৭০ মিটার, অপরটির দৈঘ্য ১৫০ মিটার ও প্রস্থ ৯০ মিটার। খননে বেরিয়ে আসা মসজিদটির কারুকাজ ও ইটের আকৃতি সুলতানী আমলের। সংস্কার ও কারুকাজ সংযোজন হয়েছিল মুঘল যুগে।

একই থানার জাফরপুর গ্রামে একটি মসজিদের ইটের নকশা ও কারুকাজে রোয়াইল বাড়ির মসজিদের ইট ও কারুকাজের সঙ্গে মিল রয়েছে। মনে হয় এ দুটি মসজিদ একই সময়ে প্রাতিষ্ঠা লাভ করেছিল। একই এলাকা পরিখা বেষ্টিত ছিল বলে প্রমাণ মিলে। নোয়াপাড়া গ্রামের জমিদার ও আশুলিয়া গ্রামের অনেক প্রাচীন স্থাপত্য আজ বিলুপ্ত।

খননের ফলে উন্মোচিত ফলাফল
দূর্গের উত্তর বেষ্টনী প্রাচীরের প্রাপ্ত সীমার উপর উত্তর পশ্চিম কোণ হতে ১২৫ ফুট পূর্ব দিকে অর্থ্যাৎ দূর্গের অভ্যান্তর ভাগের উত্তরাংশের উত্তর বাগুর মধ্যবর্তীস্থানে বুরম্নজ টিবিটির অবস্থান। খননের ফলে উন্মোচিত ৯৪‘´৬৯’ পরিমাপের ধ্বংস প্রাপ্ত লৌকিক ইমারতের উচ্চতা দূর্গ-চত্ত্বর হতে ২০ ফুট। চূঁড়ায় আরোহনে ব্যবহৃত অক্ষত সিড়িটি আবিষ্কৃত হয় ইমারতটির দক্ষিণ পাশ দিয়েই কিন্তু চুঁড়া থেকে অবতরণের সম্ভাব্য স্থানটি অত্যমত্ম ধ্বংস প্রাপ্ত। ইমারত কাঠামোটির চূড়াঁয় প্রথম নির্মাণ যুগের দুটি কক্ষের নির্দশন রয়েছে। এ কাঠামো থেকেই দূর্গের বাহিরের উটের বেষ্টনী প্রাচীরের উৎপত্তি হয়েছে। এখানে খননের ফলে ৩টি সত্মর উন্মোচিত হয়েছে এবং প্রাপ্ত প্রত্ন সম্পদের মধ্যে রয়েছে মৃৎ পাত্রের ভগ্নাংশ, পোড়া মাটির তেরাব এবং রঙ্গের প্রলেপযুক্ত ইট।

বার দুয়ারী টিবি
দুর্গাভ্যমন্তরের দক্ষিণাংশের উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত বার দুয়ারী টিবিতে খননের ফলে ৭৪‘´৪৬’ পরিমাপের আয়তনের একটি মসজিদের ভূমিনক্সা আবিষ্কৃত হয়েছে। একটি পূর্ব দেয়ালে ৫টি এবং উত্তর দেয়ালে ৩টি করে দরজা আর পশ্চিম দেয়ালে পাশাপাশি ৩টি ভিন্নাকৃতির মেহ্রাব ছিল বলে অনুমিত হয়। প্রতি সারিতে ৪টি করে দু’সারিতে ৮টি পাথরের পিলার ছিল যার কিছু অংশ এখনো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়ানো রয়েছে। আর দেয়ালগুলো ৩‘-৬’ থেকে ৩‘-৮’ প্রশ্বস্ত এবং ৬‘´৬’ চওড়া। দেয়ালে পস্নাষ্টারের আলামত পাওয়া যায়নি এবং দেয়ালের বহিরাবরণ পোড়া মাটির অলংকৃত ইট দ্বারা শোভিত ছিল। এর নির্মাণে পাতলা ইট ঝিনুক চুন ও বিশেষ ধরণের মসলা ব্যবহৃত হয়েছে।

মুঘল আমলে এটি ছিল একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র যা প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন। প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ, সুলতানী আমল ও ইংরেজ আমলের প্রথম দিকেও এই স্থানের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল। ঐতিহাসিক নিদর্শন, কারুকার্য আর স্থাপত্য কীর্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেন।

পটভূমি ও ইতিহাস
গঠনানুযায়ী এটিকে মহাজাদপুরস্থ এবং গৌড়ের ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের সাথে তুলনা করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এটাও ধারণা করেন যে, এটা সম্ভাবত মুঘল আমলের কোন সেনানায়কের বাস ভবন পপ্রহরী সৌধ হয়ে থাকবে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এটি নির্মাণকালের কোন তারিখ খচিত স্বর্ণলিপি আবিষ্কার করতে পারেনি।

এ প্রত্নতাত্ত্বিক দূর্গটির পশ্চিমে বেতাই নদী এবং অন্য তিনটি দিক পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। দূর্গটির প্রারম্ভেই রয়েছে সিংহদ্বার টিবি এর অভ্যমত্মরভাগ পূর্ব পশ্চিমে লম্বা। একটি ইটের প্রাচীর দ্বারা দু’অংশে বিভক্ত। অংশ দুটির মধ্যে উত্তরেরটি অপেক্ষাকৃত বড়, পরিমাণে ৪৯৭ ফুট এবং আবার পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে দ্বিতীয় বেষ্টনী প্রাচীর দ্বারা আবন্ধ। উত্তরাংশে রয়েছে একটি বুরম্নজ টিবি, সানবাঁধানো পুরম্নক ও একটি কবরস্থান। দূর্গটির দক্ষিণের অংশটিতে রয়েছে বার দুয়ারী টিবি। বেষ্টনী প্রাচীর এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পাথর। আর এর আভ্যমত্মরীণ মোট পরিমাণ ৮২০‘´৫৭০’।১৯৯২-‘৯২ ও ‘৯২-৯৩’ অর্থ বছরে দূর্গাভ্যমত্মরে পরীক্ষামূলক খনন কার্য পরিচালনা করা হলে বুরুজ টিবিতে একটি লৌকিক ইমারতের কাঠামো এবং বার দুয়ারী টিবিতে মসজিদের ভূমি নকসা আবিষ্কৃত হয়।

টংক শহীদ স্মৃতি সৌধ, দুর্গাপুর
বৃটিশ ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবীতে বৃহত্তর উত্তর ময়মনসিংহের কৃষকগণের সংগ্রাম কৃষক বিদ্রোহ ও টংক আন্দোলন নামে পরিচিত। আন্দোলনের প্রাণ শক্তিই ছিল আদিবাসী কৃষকগণ। তাঁদের এ মহান আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা স্বরুপ সুসং দুর্গাপুরে এম.কে.সি.এম সরকারী স্কুলের পশ্চিম পার্শ্বে ৩২ শতাংশ জমির উপর টংক শহীদ স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়। এখানে প্রতি বছর ৩১শে ডিসেম্বর মহান নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কমরেড মনি সিং এর মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হয়। মনিমেলা নামে এ অনুষ্ঠান ৭দিন যাবৎ চলে।

বৃটিশ ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবীতে বৃহত্তর উত্তর ময়মনসিংহের কৃষকগণ ১৯৩৬ হতে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সংগ্রাম আন্দোলন চালিয়ে যায়। এটি কৃষক বিদ্রোহ ও টংক আন্দোলন নামে পরিচিত। আন্দোলনের প্রাণ শক্তিই ছিল আদিবাসী কৃষকগণ, বিশেষ করে হাজং আদিবাসীগণ (ললিত সরকার হাজং, বিপিন গুন, পরেশ হাজং, রেবতী অস্বমনি ও রাশমনির নেতৃত্বে এ আন্দোলন সংগঠিত হয়)। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও মেহনতি মানুষের নেতা কমরেড মনি সিংহ ১৯৪০ সালে দশাল গ্রামের বাঙ্গালী কৃষকদেরকে নিয়ে এ আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সূদীর্ঘ ১৩ বছর আন্দোলন সংগ্রামে এ অঞ্চলের বহু কৃষক প্রাণ হারান।

উপজেলা পরিষদ থেকে ৫০০ মিটার দক্ষিণে এমকেসিএম সরকারী হাই স্কুল সংলগ্ন টংক স্মৃতি সৌধ।

রাণীমাতা রাশমণি স্মৃতি সৌধ, দুর্গাপুর
উপজেলা পরিষদ হতে ছয় কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেড়াতলী গ্রামে চৌ-রাস্তা মোড়ে রাশমণি স্মৃতি সৌধ অবস্থিত। রাশমনি হাজং ছিলেন টংক ও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী।

রাশমনি হাজং ছিলেন টংক ও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। তিনি ১৮৯৮ সালে ধোবাউড়া উপজেলায় বেদীকুড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কৃষক ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে ৩১শে জানুয়ারী কুমদিনী হাজংকে বাচাতে গিয়ে মুখোমুখি সংগ্রামে ব্রিটিশ বাহিনীর গুলিতে বহেরাতলী গ্রামে তার সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজংসহ শহীদ হন। রাশমনি ও সুরেন্দ্র হাজং টংক আন্দোলনের প্রথম শহীদ। রাশমনির দায়ের আঘাতে দুজন ব্রিটিশ পুলিশ নিহত হয়। এই বীর যোদ্ধার স্মরণে হাজংলতা রাশমনি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন। প্রতিবছর ৩১শে জানুয়ারী রাশমনি দিবস ও টংক শহীদ দিবস পালন করা হয়।

ঢাকা থেকে বাস যোগে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ ভায়া শ্যামগঞ্জ দুর্গাপুর অথবা ঢাকা থেকে বাসযোগে নেত্রকোণা, নেত্রকোণা থেকে দুর্গাপুর। সোমেশ্বরী নদী পাড় হয়ে রিক্সা বা হোন্ডায় অর্ধ কাচা-পাকা রাস্তা দিয়ে বহেড়াতলী রাশিমণি স্মৃতি সৌধে যাওয়া যায়।

কমলা রাণী দিঘী, দুর্গাপুর
উপজেলা সদর হতে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই কমলা রাণী দিঘী। এই কমলা রাণী দিঘী সাগর দিঘী নামে পরিচিত। দিঘীটি পুরোপুরি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এর দক্ষিণ পশ্চিম পাড় এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে।

কিংবদন্তি আছে যে, ১৫ শতকের শেষ দিকে সুসং দুর্গাপুরের রাজা জানকি নাথ বিয়ে করেন কমলা দেবী নামে এক সুন্দরী মহিলাকে। রাণী কমলা দেবী যেমনি রূপেগুণে সুন্দরী ছিলেন তেমনি ছিলেন পরম ধার্মিক।

রাজা জানকি নাথও ছিলেন পরম প্রজা হিতৈষী। রাণীর গর্ভে একপুত্র সন্তান জন্ম নিল। পুত্রের নাম রাখা হল রঘুনাথ। রাজা জানকি নাথ প্রজাদের মঙ্গলার্থে পানির অভাব নিবারণের জন্য একটি পুকুর খনন করেন কিন্তু পুকুরে আর পানি উঠল না। রাজা মহা চিন্তায় পড়লেন। একরাতে রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হন রাণী কমলা দেবী যদি পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পূজো দেন তাহলে পুকুরে পানি উঠবে। রাণী কমলা দেবী প্রজাদের মঙ্গলার্থে পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পূজোয় বসলেন। সহসা চারিদিক দিয়ে পানি উঠতে শুরু করল। পানি রাণী কমলা দেবীকে স্পর্শ করল। রাণী কমলা দেবী উঠে দাঁড়ালেন এবং কড়জোড়ে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পানি বেড়েই চলল, পানি বাড়তে বাড়তে হাঁটু পেরিয়ে কোমরে পৌঁছালো। রাজা জানকি নাথ অস্থির হয়ে গেলেন। রাণীকে পাড়ে ভিড়ার জন্য চিৎকার দিতে শুরু করলেন। ততক্ষণে পানি রাণীকে ডুবিয়ে ফেলল। রাণী আর পানি থেকে উঠে এলেননা। পানিতে একাকার হয়ে মিশে গেলেন। রাজা জানকি নাথ এ দৃশ্য দেখে বিচলিত হলেন। তিনি অস্থির হয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে শুরু করলেন। কয়েক মাসের শিশু সন্তান রঘু যে মাতৃদুগ্ধ ছাড়া আর কিছুই খায় না। রাজা জানকি নাথ এই চিন্তায় কিংকর্তব্য বিমূঢ় হলেন। অবশেষে তিনি এক রাত্রে স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন। শিশু সন্তান রঘুকে পুকুরের পাড়ে রেখে আসলে রাণী কমলা দেবী তাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন তবে শর্ত যে, রাজা কখনো রাণীকে স্পর্শ করতে পারবেন না। রাজা জানকি নাথ গভীর রাতে শিশু সন্তানটিকে পুকুরের পাড়ে রেখে আসতেন আর রাণী কমলা দেবী তার সন্তানকে বুকের দুধ খাইয়ে আবার পানিতে চলে যেতেন। এই দৃশ্য রাজাকে খুব যন্ত্রনা দিত। একদিন মধ্যরাতে যখন রাণী কমলা দেবী তার সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন তখন রাজা জানকি নাথ কমলা দেবীকে ধরার জন এগিয়ে গেলেন। রাণী রাজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। পরে রাজা রাণীর চুলে ধরলেন কিন্তু রাণীকে আর রাখতে পারলেন না। রাণী পানিতে নেমে পানির সাথে একাকার হয়ে গেলেন। পর থেকে আর শিশু সন্তানটিকে দুধ খাওয়াতে এলেননা। রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হন যদি আর ৭ দিন বুকের দুধ খাওয়ানো যেত তাহলে শিশু সন্তান রঘু দিক বিজয়ী, প্রতাপি বীর হিসাবে গণ্য হত। যতদুর জানা যায় রাজা রঘুর আমলেই সুসং দুর্গাপুর শক্তিশালী পরগনা হিসাবে গণ্য হয়েছিল। এই রাজা রঘুই জঙ্গল বাড়ী দূর্গ আক্রমণ করেন এবং বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়, কেদার রায়কে পরাজিত করেন। পরে তিনি মুঘল সম্রাট এর নিকট থেকে মহারাজা উপাধি লাভ করেন।

ঢাকা থেকে বাস যোগে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ ভায়া শ্যামগঞ্জ দুর্গাপুর অথবা ঢাকা থেকে বাসযোগে নেত্রকোণা, নেত্রকোণা থেকে দুর্গাপুর। উপজেলা পরিষদ থেকে রিক্সা বা মোটর সাইকেলে বিরিশিরি ব্রীজ পার হয়ে বামপাশে গুজরীকোণার পাকা রাস্তা দিয়ে ১.৫ কিলোমিটার পরে কমলা রাণী দিঘীর পাড়।

সাত শহীদের মাজার, কলমাকান্দা
ঐতিহাসিক ০৭ (সাত) শহীদের মাজার কলমাকান্দা উপজেলাধীন লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ি নামক স্থানে গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এখানে ১৯৭১ সনের ২৬ জুলাই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক বাহিনীর সাথে বন্ধুক যুদ্ধে শহীদ ০৭ (সাত) জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি ও স্মৃতিসৌধ অবস্থিত।

১৯৭১ সনের ২৬ জুলাই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নাজিরপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সংলগ্ন তিন রাস্তার মিলনস্থলে পাক বাহিনীর সাথে বন্ধুক যুদ্ধে ০৭ (সাত) জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাগণের মরদেহ বর্ণিত ফুলবাড়িয়া নামক স্থানে সমাহিত করা হয়। উক্ত সমাধি সাত শহীদের মাজার নামে পরিচিত।

হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (রাঃ)-এঁর মাজার শরীফ, মদনপুর, নেত্রকোণা সদর
নেত্রকোণা জেলা শহর হতে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে নেত্রকোণা – কেন্দুয়া সড়কের পাশে হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (রাঃ)-এঁর মাজার শরীফ অবস্থিত।

বিজয়পুর পাহাড়ে চিনামাটির নৈসর্গিক দৃশ্য, দুর্গাপুর
দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া মৌজায় বিজয়পুরের সাদা মাটি অবস্থিত। বাংলাদেশের মধ্যে প্রকৃতির সম্পদ হিসেবে সাদা মাটির অন্যতম বৃহৎ খনিজ অঞ্চল এটি। ছোট বড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমি জুড়ে প্রায় ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এই খনিজ অঞ্চল। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে এই অঞ্চলে সাদামাটির পরিমাণ ধরা হয় ২৪ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা বাংলাদেশের ৩ শত বৎসরের চাহিদা পুরণ করতে পারে।

চিনা মাটির প্রাচীন ইতিহাস না জানা গেলেও ১৯৫৭ সাল থেকে এ মাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম কোহিনুর এলুমিনিয়াম ওয়ার্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই সাদামাটি উত্তোলনের কাজ শুরু করে। পরে ১৯৭৩ সালে বিসিআইসি সাদামাটি উত্তোলনে যোগ দেয়। বর্তমানে ৯টি কোম্পানী এই সাদামাটি উত্তোলনের কাজ করছে। প্রায় ৩০০ জন শ্রমিক এই মাটি উত্তোলনের সাথে জড়িত। বিভিন্ন রংয়ের মাটি, পানি ও প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মনকে বিমোহিত করে। সাদা, গোলাপী, হলুদ, বেগুনি, খয়েরী, নিলাভ বিভিন্ন রংয়ের মাটির পাহাড় চোখকে জুড়িয়ে দেয়। সাদামাটি এলাকা জুড়ে আদিবাসীদের বসতি।

সোমেশ্বরী নদী পাড়হয়ে রিক্সা বা হোন্ডায় অর্ধ কাচা-পাকা রাস্তা দিয়ে বিজয়পুরের সাদামাটি অঞ্চলে যাওয়া যায়।

সুসলরাজ
সুসলরাজ রঘুনাথ সিংহ মাধবপুর ছোট পাহাড়ের উপর একটি শিব মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সে মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। তবে মাধবপুরের সেই পাহাড়ে এখন পর্যন্ত অসংখ্য ভগ্নইট পাওয়া যায়। সুসল জমিদার বাড়ির শেষ অস্তিত্বও এখন বিলীন। ষোড়শ শতাব্দির প্রথম ভাগে সুসল রাজ জানকি নাথ মল্লিক এক বিশাল পুকুর খনন করেছিলেন। সে পুকুর স্থানীয় ভাবে কমলারাণী দীঘি নামে খ্যাত। একটি মাত্র পাড় ছাড়া কমলারাণীর দীঘির আর কোন চিহৃ নেই। কালে ভরাট হয়ে গেছে। সুসল রাজ পরিবারের প্রথম পুরুষ সুমেস্বর পাঠক একটি দশভূজা মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সে মন্দিরটি কোথায় নির্মিত হয়েছিল তা এখন আর কেউ বলতে পারেন না।

পূর্বধলার জমিদার বাড়ি ও পাগল পন্থি
পূর্বধলার জমিদার বাড়ির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে স্বাধীনতার পূর্বেই। ঘাগড়া জমিদার বাড়ির প্রাচীন ইমারত গুলো ও বাঘবেড় এবং নারায়নদহ জমিদার বাড়ির ইমারতগুলো প্রায় বিলুপ্ত। সোনাইকান্দা, লেটিরকান্দা ও একই থানার লালচাপুর গ্রামের মোঘল যুগের মসজিদ গুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইচুলিয়া গ্রামের সুলতানি যুগের মসজিদ ও আগল সরকারের আক্রার মন্দিরটি ৭১ পরবর্তি কালে বিলুপ্ত হয়েছে। লেটিরকান্দা গ্রামে পাগল পন্থিদের পারিবারিক কবর রয়েছে। সে কবরস্থানে পাগল পন্থিকরণ শাহ্, টিপু শাহ্, ছপাতি শাহ্ সহ তাঁদের বংশের অন্যান্যদের কবর রয়েছে। সে কবরস্থানের প্রাচীরটি বৃটিশ শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল, যা এখনো দাঁড়িছে আছে । কিন্তু পাগল পন্থিদের সমাধিগুলো আধুনিক টাইলসে বেঁধে দেয়ায় ঐতিহাসিক মূল্য হারিয়ে ফেলেছে।

সাত পুকুর ও হাসানকুলী খাঁর সমাধি
আটপাড়া থানার রামেশ্বরপুর ও সালকি গ্রামে সাতটি পুকুর রয়েছে। বিশাল এ পুকুরগুলো অতি প্রাচীনকালে খনন করা বলে মনে হয়। বড় পুকুরের পশ্চিম পাশে হাসানকুলী খাঁর সমাধি। সে সমাধিটি কালো শিলা দিয়ে বাঁধানো। হাসানকুলী খাঁ ছিলেন একজন পুঁথি লেখক। তার পুঁখির সুত্র ধরে বিচার করলে এ পুকুর ও সমাধিটি মোঘলযুগের বলে ধরে নিতে হয়। এ ছাড়া শুনই গ্রামের প্রাচীন দূর্গ এখন বিলুপ্ত।

অন্যান্য নিদর্শন
মদন থানার ফতেপুর ও জাহাঙ্গীরপুরের দেওয়ানদের বাতিঘরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। চাঁনগাও গ্রামে ১টি প্রচীন মসজিদ রয়েছে। ধারনা করা হয় মসজিদটি মোঘল যুগে নির্মিত হয়েছিল। জেলার মোঘল যুগে নির্মিত অন্যান্য মসজিদের আকৃতি ও প্রকৃতির সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে। এছাড়া মদন সদরে শাহ্ সুফি সাধক সৈয়দ আহম্মদ বসরির মাজার শরীফ। বারহাট্রা থানার পিরিজপুর গ্রামে প্রাচীন জোড়া পুকুর। এর মধ্যে বড় পুকুরটি ৬ শতাংশ ও ছোট পুকুরটি ২ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত। প্রাচীন পাট্রা ইটের গাথুনীতে পুকুরের ঘাট বাঁধানো ছিল। তার ধ্বংসপ্রাপ্তের চিহ্ন এখনো পরিলক্ষিত হয়। বাড়ির নাম কোর্টবাড়ি, বাজার এখন না থাকলেও স্থানের নাম দেওয়ানের বাজার। সে এলাকায় ভগ্ন ইটের ছড়াছড়ি রয়েছে। বাড়ি নির্মাণের পরিবেশ এখনো চমৎকার। আমঘোয়াইল গ্রামের দক্ষিণের সাউথপুরে একটি ভাঙ্গা ইমারত রয়েছে। যা ৩৬০ বর্গফুট। এ ইমারতটি অতি প্রাচীন তা সহজেই অনুমিত হয়। সিংদা গ্রামে একটি প্রাচীন দেব মন্দির ছিল। মন্দিরটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। বারহাট্রা বাজারের মন্দিরটিও অতি প্রাচীন তা সহজেই অনুমিত হয়।

মোহনগঞ্জের সেখের বাড়ির মসজিদটি সুলতানি আমলে নির্মিত। মাঘান গ্রামে মোঘল যুগের আরো একটি মসজিদ রয়েছে। দৌলতপুর গ্রমে ৮৭৬ বঙ্গাব্দে নির্মিত পাশাপাশি দুটি মন্দির আছে। সেথায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমারতগুলো এখন তার শেষ চিহ্নও ধরে রাখতে পারেনি।

খালিয়াজুরী থানার প্রাচীন স্থাপত্য বলতে শুধুমাত্র একটি পর্যবেক্ষণ ইমারতের ভাঙ্গা অংশ রয়েছে। সেই ইমারতটি প্রাচীন বলে অনুমান করা হয়।

নেত্রকোণা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শ্যামলী
ওগো শ্যামলী ,
আজ শ্রাবণে তোমার কালো কাজল চাহনি
চুপ করে থাকা বাঙালি মেয়েটির
ভিজে চোখের পাতায় মনের কথাটির মতো ।
তোমার মাটি আজ সবুজ ভাষায় ছড়া কাটে ঘাসে ঘাসে
আকাশের বাদল – ভাষার জবাবে ।
ঘন হয়ে উঠল তোমার জামের বন পাতার মেঘে ,
বলছে তারা উড়ে – চলা মেঘগুলোকে হাত তুলে ,
“ থামো , থামো —
থামো তোমার পুব বাতাসের সওয়ারি । ”
পথের ধারে গাছতলাতে তোমার বাসা , শ্যামলী ,
তুমি দেবতাপাড়ায় বেদের মেয়ে ,
বাসা ভাঙ বারে বারে , খালি হাতে বেরিয়ে পড় পথে ,
এক নিমেষে তুমি নিঃশেষে গরিব , তুমি নির্ভাবনা ।
তোমাকে যে ভালোবেসেছে
গাঁঠছড়ার বাঁধন দাও না তাকে ;
বাসর – ঘরের দরজা যখন খোলে রাতের শেষে
তখন আর কোনোদিন চায় না সে পিছন ফিরে ।
মুখোমুখি বসব বলে বেঁধেছিলেম মাটির বাসা
তোমার কাঁচা – বেড়া – দেওয়া আঙিনাতে ।
সেদিন গান গাইল পাখিরা ,
তাদের নেই অচল খাঁচা ;
তারা নীড় যেমন বাঁধে তেমনি আবার ভাঙে ।
বসন্তে এ পারে তাদের পালা , শীতের দিনে ও পারের অরণ্যে ।
সেদিন সকালে
হাওয়ার তালে হাততালি দিলে গাছের পাতা ।
আজ তাদের নাচ বনে বনে ,

কংস নদী নিয়ে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা-
‘একবার এসেই দেখুন কংশ নদের সাথে সমুদ্রের বেশ মিল আছে।
হাসবেন না, দোহাই, আমাদের গাঁয়ের লোকেরা খুব কষ্ট পাবে।
একবার এসেই দেখুন নিজ চোখে, কংশ কোনো যা তা নদী নয়,
রীতিমতো, বেগবান—বেশ চওড়া-সওড়া। না, এর জল
সাধারণ নদীর মতোন এত মিঠা নয়, একটু লবণ লবণ ভাব আছে।
দুর্গা বিসর্জনে গিয়ে এর লবণজলের স্বাদে আমি বারবার আঁতকে উঠেছি—
আরে, এ তো শুধু নদী নয়, এ যে সমুদ্রের ছদ্মবেশী রূপ।
কোনো দিন কাউকে বলিনি, শুধু সুদূর শৈশব থেকে মনে-মনে
মিলিয়েছি বারহাট্টার সাথে কক্সবাজার, কংশের সাথে বঙ্গোপসাগর।’

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: